আবু আহমেদ
আমার ছাত্র শামীম এখন নিজেই ব্যবসায় করে। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সে ব্যবসায় থেকে কিছু পুঁজি সরিয়ে এনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। ২০১০ সালের জুলাই পর্যন্ত সে মোটামুটি লাভে অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করে লাভসহ পুঁজি আবার নিজস্ব ব্যবসায় নিয়ে যায়। আজকে শামীম বলছে, সে বেঁচে গেছে, এবং আরো বলছে, শেয়ারবাজার শিগগির ওঠার কোনো কারণ নেই। শামীম ভাগ্যবান। কারণ, বুঝে হোক, না বুঝে হোক সময়মতো শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিতে পেরেছে। শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তোমাকে শেয়ারগুলো বিক্রি করতে বলে দিলো? সে বলল, ‘আসলে শেয়ার বিক্রির এক নম্বর কারণ হলো ব্যবসায় হঠাৎ বাড়তি পুঁজির দরকার হয়ে পড়েছিল। আর আমার নজরে ২০১০ সালের জুলাই মাসেই বাজার যথেষ্ট অতি মূল্যায়িত হয়ে গিয়েছিল।’ শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কিভাবে বুঝলে বাজার তখনই অতি মূল্যায়িত হয়ে গেছে?’ বলল, ‘কেন, যে সব আইপিও বা প্রাইমারি শেয়ার বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে এসেছিল, সেগুলো কত মূল্যে এসেছে? একটা আইপিও কিভাবে শুরুতেই পি/ই(এক্স)= ৪০ বা আয়ের তুলনায় ৪০ গুণে আসতে পারে? আর সেই আইপিও যখন সেকেন্ডারি বাজারে বেচাকেনা হতে লাগল, তখন তা গিয়ে পৌঁছল আয়ের ৬০ গুণে। এটাও কি সম্ভব? আপনিই তো আমাদের লেকচার দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ভালো কোম্পানির ক্ষেত্রে পি/ই অনুপাত বড়জোর ২৫-৩০ হতে পারে। অসম সব আলামত দেখে বুঝতে পেরেছি, আর শেয়ার বেচে দিয়েছি। অন্য কথা হলো, যখন বাজারে টার্নওভার বা বেচাকেনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তখন ছোট্ট মিউচুয়াল ফান্ড কী করে টপ-টেন-এ জায়গা করে নিলো? ওইগুলো কি বাজার অতি মূল্যায়নের লক্ষণ নয়?’ আমি শামীমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত অল্প সময়ে আমাদের শেয়ারবাজার অতি মূল্যায়িত হলো কেন?’ সে বলল, “মূল কারণ হচ্ছে অতি অল্প সময়ের মধ্যে শেয়ারবাজার অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। সবাই মিলে দাওয়াত দিয়ে লাখ লাখ লোককে এই বাজারে আনা হয়েছিল।
আপনি তো একটা কথা আমাদেরকে বলতেন, শেয়ারবাজারে সাধারণ লোক প্রবেশ করলে বাজারের অবশ্যই ক্ষতি হবে। এটাই তো হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে যারা শেয়ার কিনেছিলেন, কোন কোম্পানি কী ব্যবসায় করেছে তারা কি সেটা জানতে চেষ্টা করেছেন? তাদের বেশির ভাগ সে দিন বিনিয়োগকারী না হয়ে শেয়ার ব্যবসায়ী হয়ে পড়েছিলেন। আর শেয়ার ব্যবসায়ী হলে তারা বোঝায় যে, যখন বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে তখন লাভ করা যায়। আর পড়তে থাকলে সে ব্যবসায় ‘লালবাতি’ জ্বলবে।” শামীমের কথায় আমি বুঝতে পারলাম, সে শুধু ব্যবসায়ই বোঝে না, শেয়ারবাজারে উথান-পতনও ভালো বোঝে। এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা শেয়ারবাজার যে পড়ে যাবে, সেটা তো তুমি বুঝতে পারলে, এবার বলো শেয়ারবাজার কখন উঠবে?’ সে অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে ফেলল, শেয়ারবাজার উঠবে না। শেয়ারবাজার ওঠার জন্য দুটো উপাদান লাগে এক. এই বাজারে অর্থের বর্ধিত প্রবাহ, যেটা ২০০৯ ও ২০১০ সালে ঘটেছিল। দুই. কিছু জুয়াড়ি লোক লাগে, যারা কোনো কোনো শেয়ারকে টেনে একেবারে তুঙ্গে তুলে ফেলবে। আজকে এই দুটো উপাদানই অনুপস্খিত। শেয়ারবাজার থেকে চলে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা, আর জুয়াড়িরাও গা-ঢাকা দিয়েছে। এ অবস্খায় বাজারে রয়ে গেছে কিছু অতি সাধারণ ক্রেতা, যারা নিষ্পাপ বটে, তবে অতি আশাবাদী। ২০০৯ ও ২০১০ সালে ঋণ দেয়া বাবদ এবং নিজেদের বিনিয়োগ হিসেবে শুধু ব্যাংকগুলোর হাজার কোটি টাকা এই বাজারে বিনিয়োগকৃত ছিল। আজ সেই অর্থের এক-চতুর্থাংশও আছে কি? আর জুয়াড়িরাও এখন হতভম্ব। তাদের ওপর কে যেন নজর রাখছে। সুতরাং এখন দু-চারটি শেয়ার যে সার্কিট ব্রেকারে গিয়ে লেনদেন হবে, সে আশাও করা যায় না। আপনি হিসাব নিলে একটা বিষয় জানতে পারবেন। তা হলো, গত ছয়-সাত মাসে ব্যাংকগুলোতে কত হাজার কোটি টাকার স্খায়ী আমানত বা এফডিআর বেড়েছে। যেখানে সুদের হার মাত্র তিন মাসে দ্বিগুণ হয়, সেখানে তো শেয়ারবাজার অবশ্যই পড়ে যাবে। এসব অর্থনীতি তো আপনিই ক্লাসে অঙ্ক করে করে পড়িয়েছিলেন। আজকে যেটার অভাব হচ্ছে সেটা হচ্ছে এই অর্থনীতির সঠিক প্রয়োগ।
আপনি নিজেই তো অনেকবার বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসৃত মুদ্রানীতি শেয়ারবাজারের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন ছাড়া বাজারে তারল্য সঙ্কটের সমস্যা কোনো দিন দূর হবে না। আর সে অর্থে শেয়ারবাজারও ওঠার মতো বাড়তি অর্থপ্রবাহ লাভ করবে না। আজকে শেয়ারবাজারে কি ক্রেতা আছে? শুধু কিছু হতাশা-আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন, যারা প্রত্যহ আশা করে, এই বুঝি শেয়ারবাজার উঠবে। তবে হ্যাঁ, শেয়ারবাজারকে উঠানোর জন্য অব্যাহত পলিসি সমর্থনের দরকার হবে, সেই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও সহযোগিতা। নতুন রেগুলেটর এসইসিকে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। নতুবা একদিন কম মূল্যের আইপিও কেনার জন্যও লোক পাওয়া যাবে না।
No comments:
Post a Comment